চর্মরোগ স্ক্যাবিস রোগের লক্ষণ, প্রতিকার ও চিকিৎসা

চর্মরোগের মধ্যে স্ক্যাবিস অন্যতম একটি সংক্রামক ও অস্বস্তিকর সমস্যা, যা একটি অতিক্ষুদ্র পরজীবী মাইট—সারকোপটিস স্ক্যাবিয়াই (Sarcoptes scabiei)—এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। এই মাইটটি ত্বকের উপরের স্তরের নিচে প্রবেশ করে সুড়ঙ্গ তৈরি করে এবং সেখানে ডিম পাড়ে, ফলে তীব্র চুলকানি ও ফুসকুড়ির মতো লক্ষণ দেখা দেয়। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন, যেখানে শিশু ও প্রবীণদের মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, প্রতিবছর প্রায় ২০ কোটি মানুষ স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হন। এটি শুধু অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ নয়, বরং অতিরিক্ত ঘন সংস্পর্শ ও নির্দিষ্ট জীবনযাপনের ধারা থেকেও ছড়াতে পারে।

এই কনটেন্টে আমরা বিস্তারিতভাবে জানবো স্ক্যাবিস রোগের লক্ষণ, এর প্রতিকার, এবং চিকিৎসার সর্বশেষ কার্যকর উপায়গুলো সম্পর্কে।

স্ক্যাবিস কীভাবে ছড়ায়?

স্ক্যাবিস রোগ ছড়ায় মূলত ঘন শারীরিক সংস্পর্শ ও ব্যক্তিগত ব্যবহার্য জিনিসপত্র (যেমন: পোশাক, বিছানার চাদর, তোয়ালে) এর মাধ্যমে। এটি একটি মানব-মানব সংক্রামক রোগ, অর্থাৎ এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে ছড়াতে পারে। বিশেষ করে:

• ঘুমানোর সময় একই বিছানা শেয়ার করলে

• পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ঘন সংস্পর্শে থাকলে

• দীর্ঘ সময় ধরে রোগীর ব্যবহৃত কাপড় বা তোয়ালে ব্যবহার করলে

স্ক্যাবিস রোগের প্রধান লক্ষণসমূহ

স্ক্যাবিসে আক্রান্ত হলে নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিতে পারে:

১. তীব্র চুলকানি

• বিশেষ করে রাতের বেলা চুলকানি অনেক বেশি হয়।

• শিশুদের ক্ষেত্রে কখনও কখনও সারাদিন ধরেই চুলকানি থাকে।

২. লাল ফুসকুড়ি বা গুটিকা

• সাধারণত আঙ্গুলের ফাঁকে, কবজিতে, কনুইয়ের ভাঁজে, কোমরে, নাভির চারপাশে, স্তনের নিচে, পুরুষদের যৌনাঙ্গে বা উরুর ভাঁজে বেশি দেখা যায়।

৩. ছোট সুড়ঙ্গ বা ‘বুরো’

• মাইট ত্বকের নিচে সুড়ঙ্গ তৈরি করে, যা সূক্ষ্ম রেখার মতো দেখায়।

৪. স্ক্যাবিং বা ঘা হয়ে যাওয়া

• অতিরিক্ত চুলকানোর ফলে ঘা হতে পারে, যা জীবাণুর সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়।

স্ক্যাবিস রোগের প্রতিকার

১. পরিবারসহ চিকিৎসা গ্রহণ

• স্ক্যাবিস খুব সহজে ছড়ায়, তাই একজন সদস্য আক্রান্ত হলে পরিবারের সকলকে একইসাথে চিকিৎসা নিতে হয়।

২. ব্যবহার্য সামগ্রী জীবাণুমুক্ত করা

• সব কাপড়, বিছানা, তোয়ালে গরম পানিতে ধুয়ে রোদে শুকাতে হবে।

• ব্যবহার না হওয়া কাপড় ৩-৫ দিন প্লাস্টিক ব্যাগে বন্দি করে রাখলে মাইট মরে যায়।

৩. চুলকানি কমানোর জন্য ঘরোয়া পদ্ধতি

• নিমপাতা ও হলুদের পেস্ট ব্যবহার করা যায়।

• নারকেল তেল ও কর্পূরের মিশ্রণ উপশমে সাহায্য করতে পারে।

• তবে এসব শুধুমাত্র সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, মূল চিকিৎসার বিকল্প নয়।

স্ক্যাবিসের কার্যকর চিকিৎসা

স্ক্যাবিসের চিকিৎসা মূলত মাইটকে মেরে ফেলাই উদ্দেশ্য। এর জন্য কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ ব্যবহার করা হয়:

১. পারমেথ্রিন ৫% ক্রিম (Permethrin 5%)

• সবচেয়ে কার্যকরী ও প্রথম পছন্দের চিকিৎসা।

• পুরো শরীরে (মাথা বাদে) মেখে ৮–১২ ঘণ্টা পরে ধুয়ে ফেলতে হয়।

২. ইভারমেকটিন ট্যাবলেট (Ivermectin)

• জটিল বা বারবার ফিরে আসা স্ক্যাবিসের ক্ষেত্রে খাওয়ার ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়।

• সাধারণত একবার খাওয়ার পর ৭ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়।

৩. সালফার-ভিত্তিক মলম

• শিশু ও গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

৪. অ্যান্টিহিস্টামিন ট্যাবলেট

• চুলকানি কমাতে সাহায্য করে।

কখন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি?

• ঘরোয়া প্রতিকারেও আরাম না পেলে

• স্ক্যাবিস বারবার ফিরে এলে

• সংক্রমণ বা ঘা গুরুতর হলে

• গর্ভবতী বা শিশু আক্রান্ত হলে

সতর্কতামূলক পরামর্শ

• অপরের ব্যবহৃত জামা-কাপড় ব্যবহার না করা

• স্কুল বা হোস্টেলে আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে এলে সতর্ক থাকা

• পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং ত্বকে অস্বস্তি হলে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা

স্ক্যাবিস একটি সংক্রামক এবং বিরক্তিকর চর্মরোগ হলেও, সচেতনতা ও সঠিক চিকিৎসায় এটি পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য। রোগটির লক্ষণ সম্পর্কে সচেতন হওয়া, নিজের ও আশেপাশের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা এবং দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াই স্ক্যাবিস থেকে রক্ষা পাওয়ার মূল চাবিকাঠি।

আপনার অথবা পরিবারের কারো মধ্যে এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।