হাঁটুর ব্যথা বাড়ার কারণ, লক্ষণ ও সহজ চিকিৎসা
হাঁটুর ব্যথা কেন হয়, এর লক্ষণ কী, এবং কীভাবে চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্ভব—জানুন হাঁটুর ব্যথা নিয়ে বিস্তারিত ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শসহ একটি পূর্ণাঙ্গ গাইড।

হাঁটু মানবদেহের সবচেয়ে জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ অস্থিসন্ধিগুলোর একটি, যা শরীরের পুরো ওজন বহন করে। প্রতিদিনের চলাফেরা, বসা, ওঠা, সিঁড়ি বাওয়া কিংবা খেলাধুলায় হাঁটু অবিচ্ছেদ্য ভূমিকা রাখে। ফলে হাঁটুতে ব্যথা হলে জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এই সমস্যা প্রায় সব বয়সী মানুষের মধ্যেই দেখা যায়।
আজকের এই প্রতিবেদনে বিস্তারিত জানবো হাঁটুর ব্যথার কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ সম্পর্কে।
হাঁটুর ব্যথার সাধারণ কারণসমূহ
হাঁটুর ব্যথার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। নিচে এর প্রধান কারণগুলো সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো:
১. অস্টিওআর্থ্রাইটিস (Osteoarthritis)
বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাঁটুর জয়েন্ট ক্ষয় হতে থাকে, যাকে বলা হয় অস্টিওআর্থ্রাইটিস বা বয়সজনিত বাত। এটি সবচেয়ে সাধারণ কারণ, বিশেষত ৫০ বছর বয়সের পর।
২. রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস ও অন্যান্য বাত রোগ
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস (RA), গাউট, স্পন্ডাইলোআর্থ্রাইটিস ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহজনিত রোগ হাঁটুর জয়েন্টে আক্রমণ করে ব্যথা তৈরি করতে পারে।
৩. আঘাত বা ইনজুরি
খেলাধুলা, সড়ক দুর্ঘটনা বা হঠাৎ পড়ে গেলে হাঁটুর লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়া (ACL tear), কার্টিলেজ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বা হাড় ভেঙে যাওয়া থেকে ব্যথা শুরু হতে পারে।
৪. সংক্রমণ (সেপটিক আর্থ্রাইটিস)
ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ হাঁটুর জয়েন্টে হলে তা তীব্র ব্যথা, ফুলে যাওয়া এবং জ্বরের সৃষ্টি করতে পারে। একে বলা হয় Septic Arthritis।
৫. যক্ষ্মা (টিউবারকুলোসিস বা টিবি)
শরীরের যেকোনো অঙ্গের মতো হাঁটুর জয়েন্টেও যক্ষ্মার সংক্রমণ হতে পারে, যা ধীরে ধীরে ব্যথা ও বিকৃতি সৃষ্টি করে।
৬. রক্তবাহিত রোগ
হিমোফিলিয়া, লিউকেমিয়া বা লিম্ফোমার মতো রক্তের রোগে জয়েন্টে রক্তপাত হয়, যা হাঁটু ব্যথার কারণ হতে পারে।
৭. ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামের ঘাটতি
শিশু ও তরুণদের মধ্যে ভিটামিন ডি-এর অভাবে হাঁটুর চারপাশে ব্যথা, ক্লান্তি ও ম্যাসাজে স্বস্তি পাওয়ার লক্ষণ দেখা যায়।
৮. টিউমার বা ক্যানসার
হাঁটুর হাড়ে প্রাথমিক টিউমার অথবা শরীরের অন্য কোনো অংশের ক্যানসার হাঁটুতে ছড়িয়ে পড়লে ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।
হাঁটুর ব্যথার লক্ষণসমূহ
হাঁটুর ব্যথার পাশাপাশি আরও কিছু উপসর্গ দেখা দিতে পারে:
-
হাঁটুতে ফোলা ও লালচে ভাব
-
জয়েন্টে গরম অনুভব হওয়া
-
হাঁটু বাঁকানো বা সোজা করতে কষ্ট হওয়া
-
সিঁড়ি উঠা-নামায় সমস্যা
-
হাটতে গিয়ে হোঁচট খাওয়া বা ভারসাম্য হারানো
-
দীর্ঘমেয়াদে হাঁটুর আকৃতি বিকৃত হয়ে যাওয়া (যেমন: bow legs বা knock knees)
হাঁটুর ব্যথার চিকিৎসা
চিকিৎসার ধরণ নির্ভর করে ব্যথার কারণ, তীব্রতা, রোগীর বয়স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত অবস্থার ওপর। সাধারণত নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করা হয়:
১. সঠিক রোগ নির্ণয়:
-
এক্স-রে, এমআরআই, ব্লাড টেস্ট, জয়েন্ট ফ্লুইড অ্যানালাইসিস ইত্যাদি
-
রোগীর ব্যথার ধরন বুঝে চিকিৎসা পরিকল্পনা
২. ওষুধ ও থেরাপি:
-
ব্যথানাশক ওষুধ (NSAIDs)
-
বাত রোগে DMARDs বা স্টেরয়েড
-
সংক্রমণের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক
-
হিমোফিলিয়া বা রক্তরোগে রক্ত বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
৩. জীবনযাপন পরিবর্তন:
-
শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ
-
হাঁটার জন্য সঠিক জুতা ব্যবহার
-
প্রয়োজন হলে লাঠি বা ওয়াকার ব্যবহার
-
ফিজিওথেরাপি ও ব্যায়াম
৪. সার্জারির প্রয়োজন:
যদি হাঁটুর জয়েন্ট সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে আর্থ্রোস্কপি বা টোটাল নি রিপ্লেসমেন্ট (TKR) এর মতো সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।
হাঁটুর ব্যথা প্রতিরোধে যা করবেন
-
নিয়মিত ব্যায়াম করুন, বিশেষ করে হাঁটুর মাংসপেশি শক্তিশালী করতে
-
ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
-
বসা-ওঠার সময় সতর্ক থাকুন
-
পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়ামযুক্ত খাবার খান
-
হাই হিল বা অসুবিধাজনক জুতা এড়িয়ে চলুন
-
যে কোনো ব্যথা বা আঘাতকে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা নিন
হাঁটুর ব্যথা সামান্য মনে হলেও এটি দীর্ঘমেয়াদে চলাফেরা, বসা বা স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করতে পারে। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। যেকোনো অস্বাভাবিকতা দেখা দিলেই অর্থোপেডিক্স বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
What's Your Reaction?






