মাওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চ আন্দোলন

১৯৭৬ সালের ফারাক্কা লং মার্চ ছিল মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের পানির অধিকারের জন্য এক ঐতিহাসিক প্রতিবাদ। জেনে নিন এই আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, প্রভাব ও আজকের প্রাসঙ্গিকতা।

May 16, 2025 - 16:20
 0  36
মাওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চ আন্দোলন
মাওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চ আন্দোলন

বাংলাদেশের ভূগোল ও অর্থনীতি গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। দেশের মোট ভূমির প্রায় ৭০ ভাগ নদীবিধৌত হওয়ায় কৃষি, মাছ চাষ, পরিবহন এমনকি গ্রামীণ অর্থনীতিও নির্ভর করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের ওপর। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ভারতের ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার পর এ প্রবাহে আসে ভয়ানক পরিবর্তন।

এখানেই শুরু হয় বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার পানি সংকটের ইতিহাস। আর এই সংকটের বিরুদ্ধে প্রথম জাতীয় পর্যায়ের সংগঠিত প্রতিবাদ গড়ে তোলেন এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব—মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।

 

ফারাক্কা ব্যারাজ কী এবং কেন তৈরি হয়েছিল?

ফারাক্কা ব্যারাজ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার ফারাক্কায় গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত একটি জল নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখা।

১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ভারত এই প্রকল্পের কাজ শুরু করে এবং ১৯৭৫ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করে। ব্যারাজের মাধ্যমে গঙ্গার একটি বড় অংশের পানি ভাগ করে হুগলি নদীতে প্রবাহিত করা হয়। এতে হুগলি নদীর পলিমাটি সরে গিয়ে কলকাতা বন্দরের গভীরতা পুনরুদ্ধার হয়।

 

ফারাক্কা ব্যারাজের নেতিবাচক প্রভাব

ফারাক্কা ব্যারাজ চালু হওয়ার পরে বাংলাদেশে যা ঘটেছিল তা শুধু পরিবেশগত বিপর্যয় নয়, ছিল একপ্রকার অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট। নিচে এর কিছু উল্লেখযোগ্য প্রভাব তুলে ধরা হলো:

১. নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়া

শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা নদীর পানির প্রবাহ ৫০%–৭৫% পর্যন্ত কমে যায়, যার ফলে নদী হারায় তার নাব্যতা। অনেক স্থানে নদী পায়ে হেঁটে পার হওয়া সম্ভব হয়ে পড়ে।

২. খরার প্রকোপ বৃদ্ধি

বিশেষত রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ এলাকায় দীর্ঘ খরা দেখা দেয়। চাষাবাদ ব্যাহত হয়, ফসলহানিতে কৃষকরা পথে বসে।

৩. ভূগর্ভস্থ পানির স্তর হ্রাস

নদী শুকিয়ে যাওয়ার ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। টিউবওয়েল, কুয়া শুকিয়ে যায়, পানির জন্য হাহাকার দেখা দেয়।

৪. প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত

পদ্মার শাখা নদীগুলোতে মাছ পাওয়া কমে যায়, নদীর উপর নির্ভরশীল জীবজগৎ বিপন্ন হয়ে পড়ে।

৫. নদীভাঙন ও মরুকরণ প্রক্রিয়া

নদীভাঙন বেড়ে যায়, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়, পশ্চিমাঞ্চলের কিছু অংশে আংশিক মরুভূমি পরিস্থিতি তৈরি হয়।

 

৬ মে ১৯৭৬: লং মার্চের ইতিহাসে এক দিন

সেদিন ছিল ১৬ মে ১৯৭৬। রাজশাহীর সান্তাহার থেকে শুরু হয় এক বিশাল মিছিল। লক্ষাধিক সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, বয়স্ক—সকলেই এক কণ্ঠে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সামনে হাঁটছেন ভাসানী, তাঁর পরনে সাদা পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, কাঁধে গামছা। বয়স সত্তরের বেশি, কিন্তু মনে অদম্য সাহস।

তিনি বলছেন—“ফারাক্কা বাঁধ খুলে দাও, না হলে বাঁধ ভেঙে দেব।”

এই মিছিল চলে রাজশাহীর গোদাগাড়ী পর্যন্ত। পদ্মার তীরে দাঁড়িয়ে ভাসানী উত্তোলন করেন জাতীয় পতাকা। 

 

মাওলানা ভাসানীর ঘোষণা 

“ফারাক্কা বাঁধ খুলে দাও, না হলে ভেঙে দেব”- এই ঘোষণায় ছিল না কোনো সহিংসতার ইঙ্গিত, বরং ছিল রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক শান্তিপূর্ণ, শক্তিশালী বার্তা। তিনি জানতেন, পানি হচ্ছে ভবিষ্যতের অস্ত্র। তাই তিনি বলেন—

“নদী বন্ধ মানে দেশ বন্ধ।”

“পানি না পেলে, পদ্মা না বাঁচলে, বাংলা মরুভূমি হয়ে যাবে।“

 

ফারাক্কা আন্দোলনের ফলাফল

আন্তর্জাতিক মনোযোগ

ফারাক্কা লং মার্চের পর BBC, Voice of America-সহ অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিষয়টি প্রচারিত হয়।

সরকারের তৎপরতা

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম ও সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসেন।

চুক্তি স্বাক্ষর

১৯৭৭ সালে একটি ৫ বছর মেয়াদি ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা পরে নবায়ন হয় ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ. ডি. দেবগৌড়ার মধ্যে ৩০ বছরের একটি চুক্তির মাধ্যমে।

 

আজকের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিকতা

২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে দেখা যাচ্ছে, ফারাক্কা ইস্যুর মতোই তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি আজও হয়নি। শুষ্ক মৌসুমে নদীগুলোর পানির স্তর কমে যায় এবং তিস্তা নদীর প্রবাহ প্রায় ১০০ কিউসেকের নিচে নেমে আসে, যেখানে বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিল ৪,৫০০ কিউসেক।

এই প্রেক্ষাপটে মাওলানা ভাসানীর লং মার্চ আমাদের জন্য প্রেরণা ও শিক্ষা দুই-ই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ন্যায্য অধিকার রক্ষার লড়াই এখনো চলমান।

 

মাওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লং মার্চ ছিল জলাধিকার, জাতীয় স্বার্থ এবং পরিবেশগত ন্যায্যতার পক্ষে দাঁড়ানোর এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। তিনি দেখিয়েছেন, রাজনীতি মানে কেবল ক্ষমতার খেলা নয়—মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার সংগ্রাম।

আজ যখন জলবায়ু পরিবর্তন, নদী দখল ও পানিসঙ্কট আমাদের সামনে নতুন করে হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন ভাসানীর নেতৃত্ব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—প্রকৃতি রক্ষা ছাড়া কোনো উন্নয়নই টেকসই হতে পারে না।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow