পহেলা বৈশাখ, বিজু, সাংগ্রাই ও বৈসু কিভাবে একই সূত্রে গাঁথা

বাংলাদেশের চারটি গুরুত্বপূর্ণ বর্ষবরণ উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু ও পহেলা বৈশাখ—কীভাবে একসূত্রে গাঁথা, সেই ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরা হয়েছে এই গবেষণামূলক ব্লগে।

Apr 11, 2025 - 11:33
 0  107
পহেলা বৈশাখ, বিজু, সাংগ্রাই ও বৈসু কিভাবে একই সূত্রে গাঁথা
পহেলা বৈশাখ, বিজু, সাংগ্রাই ও বৈসু কিভাবে একই সূত্রে গাঁথা

বাংলাদেশ একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ বহু-সাংস্কৃতিক দেশ, যেখানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ঐতিহ্য ও রীতিনীতির মধ্য দিয়ে জাতিসত্তা গঠিত হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী যেমন চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা এবং সমতলের বাঙালি জনগোষ্ঠী বর্ষবরণকে ঘিরে যে উৎসবগুলো পালন করে—বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু ও পহেলা বৈশাখ, তা শুধুমাত্র আলাদা উৎসব নয়, বরং একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রবাহের অংশ।

এসব উৎসব নাম, ধরন ও আনুষ্ঠানিকতায় ভিন্ন হলেও মূলত একেই লক্ষ্য করে এগিয়ে চলে—নতুন বছরের সূচনা, প্রাচীন ঐতিহ্যের সংরক্ষণ, সামাজিক সংহতি এবং জাতিগত পরিচয়ের প্রকাশ। এই গবেষণামূলক আলোচনায় অনুসন্ধান করা হবে, কীভাবে এই চারটি উৎসব একই সাংস্কৃতিক সুতায় গাঁথা এবং বাংলাদেশের জাতিসত্তা গঠনে কীভাবে এগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

উৎসবের উৎস: ইতিহাস ও উৎপত্তির দৃষ্টিতে

পহেলা বৈশাখ

পহেলা বৈশাখের সূচনা ঘটে মোগল শাসনামলে, যখন রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে বাংলা সন প্রবর্তন করা হয়। যদিও এটি ছিল প্রশাসনিক প্রয়াস, পরবর্তীতে এটি রূপ নেয় বাঙালির অন্যতম সাংস্কৃতিক উৎসবে। এখন এটি একটি ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় উৎসব যেখানে বাঙালি মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই অংশগ্রহণ করে।

বিজু, সাংগ্রাই ও বৈসু

অপরদিকে, বিজু (চাকমা), সাংগ্রাই (মারমা) ও বৈসু (ত্রিপুরা) উৎসবগুলোর মূল শেকড় রয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে। এই উৎসবগুলো ‘থিংইয়ান’, ‘সংক্রান’ বা ‘সাংক্রান্তি’ নামক বর্ষবরণ উৎসবের অংশ, যা থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, লাওস ও কম্বোডিয়ায় প্রচলিত। এগুলো হাজার বছরের পুরোনো ঐতিহ্য, যা প্রাক-বৌদ্ধ ও কৃষিনির্ভর সমাজ ব্যবস্থার প্রতিফলন।

সময়ের সমান্তরালতা: মধ্য এপ্রিলের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য

সবগুলো উৎসবই অনুষ্ঠিত হয় এপ্রিল মাসের ১২ থেকে ১৬ তারিখের মধ্যে, যা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঋতু পরিবর্তনের সময়কাল। এই সময়টিই নতুন ফসলের আগমন ও কৃষি বছরের সূচনা হিসেবে বিবেচিত।

এই মিল সময়কাল কেবল একটি ক্যালেন্ডারিক কাকতালীয়তা নয়, বরং এটি প্রমাণ করে যে বাংলার সমতল ও পাহাড়ি অঞ্চলে প্রকৃতির সাথে মিল রেখে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারা গড়ে উঠেছে।

সংস্কৃতির বিনিময় ও সহাবস্থান

পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠী দীর্ঘকাল ধরে বাঙালিদের সাথে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহাবস্থান করছে। এই সহাবস্থানের ফলেই আমরা এখন বিজু উৎসবে পান্তা-ইলিশ পরিবেশন দেখি, আবার মঙ্গল শোভাযাত্রায় পাহাড়ি পোশাকে অংশ নিচ্ছে বাঙালি যুবসমাজ। এই সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন একটি নতুন পরিচয়—"বাংলাদেশী জাতিসত্তা"—তৈরি করছে, যা বহুত্ববাদী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক।

সামাজিক সংহতির সেতুবন্ধন

উৎসব মানেই কেবল আনন্দ নয়, বরং সামাজিক সম্পর্ক জোরদার করার উপলক্ষ। বিজুর গোজ্যেপোজ্যে দিনে ছোটরা বড়দের পা ধুয়ে আশীর্বাদ নেয়, সাংগ্রাইয়ে পরস্পরকে পানি ঢেলে আনন্দ ভাগ করে নেয়া হয়, বৈসুতে নৃত্য ও লোকসংগীতের মাধ্যমে জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ হয়। আর পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত, একটি সামগ্রিক বাঙালি পরিচয়ের প্রতিনিধিত্ব করে।

জাতিসত্তা ও বহুত্ববাদ

এই উৎসবগুলো বাংলাদেশের জাতিসত্তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলে। শুধুমাত্র ভাষাভিত্তিক বা ধর্মীয় সংজ্ঞা দিয়ে কি জাতিকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু উৎসবগুলোর মধ্য দিয়ে বোঝা যায়, আসল জাতিসত্তা গঠিত হয় সংস্কৃতি, রীতিনীতি, উৎসব, জীবনাচার এবং সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে।

এই উৎসবগুলো দেখায়, মানুষের মধ্যে বিভাজনের দেয়াল নয় বরং সংস্কৃতির সেতু গড়ে তোলা সম্ভব। ভাষা, ধর্ম, জাতি সব পেরিয়ে উৎসবগুলো এক নতুন পরিচয় গড়ে: বাংলাদেশের বহুস্বরের সম্মিলিত পরিচয়।

 

বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু ও পহেলা বৈশাখ - চারটি উৎসব, চারটি ইতিহাস, কিন্তু একটাই বার্তা: “নতুন সূচনার আশাবাদ, সংস্কৃতির সম্মান এবং জাতিসত্তার উদযাপন।” তারা আমাদের শেখায়, বিভেদের চেয়ে উৎসবের শক্তি বেশি। বাংলাদেশের মত একটি বৈচিত্র্যময় দেশে এই উৎসবগুলো শুধু ঐতিহ্যের ধারক নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য সেতুবন্ধন। রাষ্ট্র যদি এই সংস্কৃতিগুলোকে সত্যিকারের মূল্যায়ন করে, তবে সম্ভব এক বহুস্বরের একতাবদ্ধ জাতি গঠন।




What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow