স্বপ্নবাজ এক তরুণ দুর্গম পাহাড়ে যেভাবে ছড়াচ্ছেন শিক্ষার আলো

বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন উথোয়াইয়ই মারমা। পোপা বদলাপাড়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে তিনি শিক্ষার দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। পড়ুন তাঁর অনুপ্রেরণাদায়ক গল্প

Mar 18, 2025 - 06:20
 0  96
স্বপ্নবাজ এক তরুণ দুর্গম পাহাড়ে যেভাবে ছড়াচ্ছেন শিক্ষার আলো
স্বপ্নবাজ এক তরুণ দুর্গম পাহাড়ে যেভাবে ছড়াচ্ছেন শিক্ষার আলো

বান্দরবানের লামা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে পোপা বদলাপাড়া। দুর্গম পাহাড়ি পথ বেয়ে সেখানে পৌঁছাতে লাগে দুই ঘণ্টারও বেশি সময়। বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি, হাসপাতাল কিংবা মোবাইল নেটওয়ার্ক—এখানে আধুনিক জীবনের এসব মৌলিক সুবিধার কোনো ছোঁয়া নেই। আরও বড় কথা, আশপাশের ২০ কিলোমিটারের মধ্যে ছিল না কোনো বিদ্যালয়ও। তবে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এবার সেই শিক্ষার আলো পৌঁছেছে পোপা বদলাপাড়ায়।

একটি স্বপ্ন, একটি বিদ্যালয়

২৭ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে ‘পোপা বদলা আশা-হোফনূং আনন্দময়ী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। প্রাথমিকভাবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস শুরু হয়েছে, যেখানে রয়েছে ৩৯ জন শিক্ষার্থী ও দুজন শিক্ষক। বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছেন এক তরুণ স্বপ্নদ্রষ্টা—উথোয়াইয়ই মারমা।

সংগ্রামী শৈশব থেকে শিক্ষার আলো ছড়ানোর পথচলা

উথোয়াইয়ই মারমার জন্ম লামার গজালিয়া ইউনিয়নের গাইন্দ্যাপাড়ায়। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বড় ছেলে তিনি। দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেই বেড়ে ওঠা, কিন্তু শিক্ষার আলো ছড়ানোর স্বপ্ন কখনো ম্লান হয়নি। প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করার পর লামা সদরের এক অভিভাবকের কাছে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যান তিনি। এরপর রাজস্থলীর বাঙ্গালহালিয়ার এক মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন। ২০০৯ সালে এসএসসি ও ২০১১ সালে এইচএসসি পাস করে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ২০১২ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন থানচির হালিরামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে বদলি হয়ে আসেন লামার চেয়ারম্যানপাড়া সরকারি বিদ্যালয়ে।

দুর্গম পাহাড়ে শিক্ষার আলো

ছবি তোলা, ভিডিও করা এবং দুর্গম পাহাড়ের মানুষের জীবনের গল্প তুলে ধরতে গিয়ে নানা সমাজসেবামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হন উথোয়াইয়ই। ২০১৫ সালে ‘উথোয়াই ভয়েজার’ নামে ফেসবুক পেজ খোলেন, যেখানে পাহাড়ি মানুষের বাস্তবতা তুলে ধরেন। এরপর শিক্ষার আলো ছড়ানোর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে আসেন।

একটি স্কুল থেকে বড় আন্দোলন

২০১৬ সালে দুর্গম ম্রো পাড়ায় ‘পাওমুম থারক্লা’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। যার বাংলা অর্থ, ‘কলি থেকে ফোটা ফুল’। কয়েকজন সহযোদ্ধার সহযোগিতায় তৈরি করেন তিন কক্ষের টিনশেড স্কুল। ধীরে ধীরে স্কুলটিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর শুরু হয় আরও বড় পরিকল্পনা—স্কুলের জন্য অর্থ সংগ্রহ। শিশুদের ছবি আঁকার কর্মশালা ও কনসার্টের মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করে ২০২১ সালে পাইনখালের পাশে তৈরি করা হয় একটি দোতলা স্কুল ভবন।

উথোয়াইয়ই থেমে থাকেননি। ২০২১ সালে লামার সরই ইউনিয়নে ‘চেননৈ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। ২০২২ সালে নাইক্ষ্যংছড়ির দৌছড়ি ইউনিয়নে গড়ে তোলেন ‘রেংয়নপাড়া আশা-হোফনূং’ স্কুল। ২০২৩ সালে লামার মাংখাইতপাড়া ও আশপাশের এলাকাগুলোতে ঘুরে দেখেন, সেখানে শিক্ষার চরম অভাব। পোপা বদলাপাড়ায় বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ তখন থেকেই শুরু হয়। সৈয়দ সাকিল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের সহায়তায় এবং স্থানীয়দের সহযোগিতায় গত বছর শুরু হয় বিদ্যালয় নির্মাণের কাজ।

একটি দিনের অভিজ্ঞতা

৬ মার্চ পোপা বদলাপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে লাল-সবুজ রঙের নতুন স্কুল ভবনটি। চার কক্ষের এই স্কুলে রয়েছে টয়লেটসহ অন্যান্য সুবিধা। শিক্ষার্থীরা দারুণ আনন্দিত। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী নিশি ত্রিপুরা জানায়, ‘স্কুলে এসে অনেক বন্ধু পেয়েছি, আমরা মজা করি, পড়াশোনা করি।’

বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় স্থানীয়রাও এগিয়ে এসেছেন। ৩৩ শতক জমি দান করেছেন মায়ারাং ত্রিপুরা। তিনি বলেন, ‘এলাকার শিশুদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে জমি দিয়েছি।’ অন্য এক অভিভাবক আছারাম ত্রিপুরা বলেন, ‘আগে স্কুল থাকলে আমাদের সন্তানদের শহরে পাঠাতে হতো না। এখন এখানে পড়তে পারবে, এটা আমাদের জন্য বড় স্বস্তি।’

বিদ্যালয় পরিচালনা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য অভিভাবকদের কাছ থেকে প্রতিমাসে ২০০ টাকা নেওয়া হয়। পাশাপাশি, পাড়ার হেডম্যানের দেওয়া ১০-১৫ একর জমিতে ফলের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। অভিভাবকেরা মাসে অন্তত দুই দিন স্বেচ্ছাশ্রম দেন, আর সেই বাগানের ফলমূল, বাঁশ ও কাঠ বিক্রি করে স্কুলের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়।

উথোয়াইয়ইর লক্ষ্য এখানেই শেষ নয়। বান্দরবানের গজালিয়া ইউনিয়নের কালোপাড়ায় এখনো কোনো স্কুল নেই। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই ‘সাইরাও থারবা’ নামে নতুন একটি বিদ্যালয় স্থাপন করতে চান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি পাহাড়ের শিশুদের চোখে নতুন স্বপ্ন দেখি। এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চাই, যত দিন বেঁচে আছি।’

উথোয়াইয়ই মারমা ও তাঁর সহযোগীদের উদ্যোগ পাহাড়ের অগণিত শিশুর জীবন বদলে দিচ্ছে। শিক্ষার আলো নিয়ে পাহাড়ের অন্ধকার দূর করতে তাঁদের এই মহতী প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবিদার।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow