আন্তর্জাতিক মে দিবসের ইতিহাস, তাৎপর্য ও বর্তমান প্রেক্ষাপট
আন্তর্জাতিক মে দিবস বা শ্রমিক দিবসের উৎপত্তি কোথা থেকে, কেন ১ মে তারিখটি বেছে নেওয়া হয়, এই দিবসের তাৎপর্য, বিশ্বজুড়ে পালনের রীতি এবং বাংলাদেশে এর বর্তমান চিত্র—জানুন বিশ্লেষণধর্মী এই ব্লগে।

অনেকেই পহেলা মে ‘মে দিবস’, ‘সরকারি ছুটি’ কিংবা ‘শ্রমিক দিবস’ হিসেবে জানেন। তবে এর পেছনে রয়েছে এক রক্তাক্ত ইতিহাস, দীর্ঘ সংগ্রাম ও বৈপ্লবিক চেতনা। এই দিবসটি কেবল একটি ছুটি নয়, বরং শ্রমজীবী মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার এক আন্তর্জাতিক প্রতীক।
শতাব্দী পেরিয়ে আসা মে দিবসের বার্তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, বিশেষত বাংলাদেশের মতো শ্রমনির্ভর অর্থনীতিতে, যেখানে শ্রমিক শ্রেণি আজও নানাবিধ বঞ্চনার মুখে।
মে দিবসের ইতিহাস: রক্ত দিয়ে অর্জিত অধিকার
১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হাজার হাজার শ্রমিক কাজ বন্ধ করে পথে নেমেছিলেন। তাঁদের একটাই দাবি ছিল— ৮ ঘণ্টা কাজের নিয়ম প্রতিষ্ঠা করা। তখনকার দিনে শ্রমিকদের প্রতিদিন ১২–১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হতো, বিনা নিরাপত্তা, অপ্রতুল মজুরি ও মানবেতর পরিবেশে।
হেইমারকেট স্কয়ার: ইতিহাসের কালো দিন
৪ মে ১৮৮৬, শিকাগোর হেইমারকেট স্কয়ারে চলছিল শ্রমিক সমাবেশ। এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি পুলিশের দিকে বোমা ছুঁড়লে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ গুলি চালায়, এতে অসংখ্য শ্রমিক নিহত হন। আটজন শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যাঁদের অনেকে ছিলেন নির্দোষ।
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সারা বিশ্বে শ্রমিকদের মধ্যে গভীর সহানুভূতি ও আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায়, ১৮৮৯ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে আয়োজিত “দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক” সম্মেলনে ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতির প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বিশ্বজুড়ে মে দিবস কেমনভাবে পালিত হয়?
-
ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি: বিশাল শ্রমিক সমাবেশ ও সরকারিভাবে স্বীকৃত ছুটি।
-
রাশিয়া ও চীন: রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণির সম্মান জ্ঞাপন।
-
যুক্তরাষ্ট্রে: যদিও মে দিবস সরকারিভাবে পালিত হয় না, তথাপি বিভিন্ন বামপন্থী সংগঠন প্রতিবছর এই দিন স্মরণ করে।
বাংলাদেশে মে দিবস: উজ্জ্বল ব্যানারের আড়ালে চাপা বাস্তবতা
বাংলাদেশে মে দিবস পালিত হয় রাষ্ট্রীয় ছুটি হিসেবে। সরকারি-বেসরকারি কর্মসূচি, র্যালি, আলোচনা সভা, সংবাদপত্রে বিশেষ প্রকাশনা, সবই চোখে পড়ে। কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের বাস্তব জীবন কি এই দিনটির প্রাপ্য মর্যাদা পায়?
বাস্তব চিত্র ও চ্যালেঞ্জ:
-
অধিকাংশ শ্রমিক এখনও ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন (বিশেষ করে গার্মেন্টস ও নির্মাণ খাতে)।
-
ন্যায্য মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাব, শ্রমিক মৃত্যু একটি নিয়মিত সংবাদ।
-
লিখিত চুক্তি, মাতৃত্বকালীন ছুটি, মেডিকেল সাপোর্ট ইত্যাদি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত।
-
ট্রেড ইউনিয়ন গঠন-এ বাধা, বিশেষ করে বেসরকারি খাতে।
-
নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য ও হয়রানি, যা প্রায়শই প্রচারবিমুখ।
মে দিবসের তাৎপর্য: শুধুই অতীত স্মরণ নয়
আজকের পৃথিবীতে অনেক কিছুই বদলেছে। অথচ শ্রমিকের মূল সমস্যাগুলো আজও থেকে গেছে, তৈরি হচ্ছে নতুন রূপে। তাই মে দিবস মানে কেবল শিকাগো ট্র্যাজেডির স্মরণ নয়, বরং এটি একটি সমাজ পরিবর্তনের বার্তা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মে দিবসের প্রাসঙ্গিকতা
১. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) যুগে শ্রমিকের নতুন চ্যালেঞ্জ
রোবট ও অটোমেশনের যুগে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান হুমকির মুখে। দক্ষতা উন্নয়ন ও পুনঃপ্রশিক্ষণের প্রয়োজন এখন সময়ের দাবি।
২. টেকসই উন্নয়ন ও সবুজ কাজের ধারণা
পরিবেশবান্ধব ও সামাজিকভাবে দায়বদ্ধ শ্রমনীতি। যেমন ‘Green Jobs’—মে দিবসের তাৎপর্যকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে।
৩. শ্রমিক-মালিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক
শুধু বিরোধ নয়, মে দিবস স্মরণ করায় সহযোগিতার পথ। যেখানে মালিক ও শ্রমিক উভয়ই উন্নয়নের অংশীদার।
মে দিবস কি শুধুই ইতিহাস?
না, মে দিবস কেবল ইতিহাস নয়। এটি বর্তমানের দর্পণ এবং ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা। এখন সময় এসেছে মে দিবসকে শুধু ছুটির দিন হিসেবে না দেখে, এর পেছনের ত্যাগ, চেতনা ও সংগ্রামকে অন্তরে ধারণ করার। শ্রমিকদের প্রতি ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা মানে দেশের টেকসই অগ্রগতির উন্নয়ন গড়া।
মে দিবস আমাদের শেখায়—অধিকার কখনো অনুগ্রহ নয়, এটি সংগ্রাম করে অর্জন করতে হয়। একটি দেশের উন্নয়ন শুধু জিডিপির সংখ্যায় মাপা যায় না। শ্রমিকের হাসি, সুরক্ষা, ও মর্যাদার ভিত্তিতে সত্যিকারের সমৃদ্ধি নির্ধারিত হয়। সুতরাং, মে দিবস মানে কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, একটি চলমান আন্দোলনের অংশীদার হওয়া।
What's Your Reaction?






