ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণায় কী আশঙ্কা উঠে এসেছিল?
২০১৯ সালে রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণায় আশঙ্কা করা হয়, কাশ্মীর সংকট থেকে শুরু হতে পারে ভারত-পাকিস্তানের পারমাণবিক যুদ্ধ। এতে তাৎক্ষণিকভাবে কোটি মানুষের প্রাণহানি এবং বৈশ্বিক জলবায়ু বিপর্যয়ের সম্ভাবনার কথা বলা হয়। জেনে নিন এই গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও পরিণতির চিত্র।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুলওয়ামা হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তৈরি হয় এক নজিরবিহীন সামরিক উত্তেজনা। এই উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় তুলে ধরা হয় দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের সম্ভাব্য চিত্র। গবেষণায় সতর্ক করা হয়, সীমিত আকারের পারমাণবিক সংঘাতও বিশ্বব্যাপী জলবায়ু ও মানবজীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
গবেষণার প্রেক্ষাপট: পুলওয়ামা, বালাকোট এবং যুদ্ধের সঙ্কেত
২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, জম্মু ও কাশ্মীরের পুলওয়ামায় ভারতের আধাসামরিক বাহিনীর ওপর জইশ-ই-মোহাম্মদের আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন জওয়ান নিহত হন। ভারত এ ঘটনার জবাবে ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলা চালায়। পরদিন পাকিস্তান পাল্টা জবাব দেয়। দুই দেশের মধ্যে এই সামরিক পাল্টাপাল্টি ঘটনাপ্রবাহকে 'আধা-যুদ্ধ পরিস্থিতি' হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
এই বাস্তবতা থেকেই রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. অ্যালান রোবোক এবং তার সহ-গবেষক দল এমন এক গবেষণা পরিচালনা করেন যেখানে অনুমান করা হয়, ভবিষ্যতে যদি এমন সংঘাত পূর্ণমাত্রার পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নেয়, তবে তার ফলাফল কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে।
গবেষণার মূল বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি
এই গবেষণায় কল্পনাভিত্তিক (hypothetical) কিছু যুদ্ধ-পরিকল্পনার ভিত্তিতে (war-game simulations) দুটি আলাদা সিনারিও তৈরি করা হয়, যেগুলোর ভিত্তি ইতিহাস, ভূরাজনীতি, এবং প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মতামত। ভারতের ও পাকিস্তানের সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের অংশগ্রহণে একাধিক ওয়ার্কশপ আয়োজন করে এসব সম্ভাব্য যুদ্ধ-সিনারিও চিত্রায়িত হয়।
প্রধান দুটি দৃশ্যকল্প ছিলঃ
-
সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়া: ভারতীয় পার্লামেন্টে আত্মঘাতী হামলায় নেতৃবৃন্দ নিহত হন। ভারত জবাবে সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে আক্রমণ করে। পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়, জবাবে ভারতও পারমাণবিক হামলা চালায়।
-
কাশ্মীরে সামরিক অভিযান: ভারত কাশ্মীরে বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালায়। পাকিস্তান সামরিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে।
সম্ভাব্য ফলাফল: প্রাণহানি, জলবায়ু বিপর্যয় ও বৈশ্বিক দুর্ভিক্ষ
গবেষণায় পূর্বাভাস দেওয়া হয়, একটি সীমিত পরমাণু যুদ্ধের প্রথম পর্যায়েই প্রায় ১২৫ মিলিয়ন (সাড়ে ১২ কোটি) মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হতে পারেন। তবে এটি শুধু মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং পরিবেশগত দিক থেকেও এক দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগের সূচনা করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
-
পরমাণু বিস্ফোরণে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ড থেকে ওঠা ধোঁয়া বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে গিয়ে সূর্যালোক প্রতিহত করবে।
-
পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা হ্রাস পাবে, কমে যাবে বৃষ্টিপাত।
-
কৃষিজ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে, বিশ্বব্যাপী খাদ্য ঘাটতির মুখে পড়বে শত কোটি মানুষ।
গবেষক রোবোক বলেন, “এই ধরনের যুদ্ধ শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে। এটি একটি ‘পারমাণবিক শীতকাল’ (nuclear winter) তৈরি করতে পারে।”
পারমাণবিক অস্ত্রের বিস্তার ও শক্তির ভারসাম্য
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর তথ্যানুসারে, বর্তমানে পাকিস্তান আনুমানিক ১৬০টি এবং ভারত প্রায় ১৫০টি পারমাণবিক অস্ত্রের মালিক। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস, ২০২৫ সালের মধ্যে এই সংখ্যা উভয় দেশের মিলিতভাবে ৪০০ থেকে ৫০০-এর মধ্যে পৌঁছাতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় পারমাণবিক উত্তেজনার মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
উল্লেখযোগ্যভাবে, ভারত এখন পারমাণবিক সাবমেরিন ধারণক্ষমতা অর্জন করেছে এবং পাকিস্তানও এ ধরণের সক্ষমতা অর্জনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
২০২৫ সালের উল্লেখ কেন?
গবেষণায় ২০২৫ সালকে একটি রেফারেন্স টাইমলাইন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে, কারণ এটি ভবিষ্যতের এমন একটি সময় যা গবেষকদের কল্পিত ঘটনাগুলোকে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ দেয়। তবে গবেষকরা স্পষ্ট করে বলেন, "এই যুদ্ধ আগামীকালও শুরু হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।"
বিশেষজ্ঞদের মতবিরোধ
এই গবেষণার পেছনে তাত্ত্বিক ভিত্তি থাকলেও কিছু বিশ্লেষক এই গবেষণাকে কল্পনাপ্রসূত বলে অভিহিত করেছেন।
ভারতের সাবেক মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জির মতে, “এই গবেষণায় বাস্তব পরিস্থিতির চেয়ে অনেক বেশি নাটকীয় কল্পনা করা হয়েছে। সত্যি বলতে, যুদ্ধ কেউ ইচ্ছা করে শুরু করে না, তবে ভুল বোঝাবুঝি বা উত্তেজনার কারণে বিপর্যয় ঘটতে পারে।”
পাকিস্তানের কায়দে আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরমাণু বিজ্ঞানী ড. পারভেজ হুডভাই এই মতের সাথে একমত, তবে তিনি এটাও বলেন, “দীর্ঘস্থায়ী উত্তেজনার মধ্যে যদি একটি ছোট ভুল হয়, সেটাই বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।”
ভবিষ্যতের জন্য থাকা সতর্কবার্তা
রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাটি সরাসরি ভবিষ্যদ্বাণী না হলেও, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবার্তা। এটি দেখায় যে, পারমাণবিক অস্ত্র যত বেশি ছড়াবে, তত বেশি মানবজাতি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।
ড. অ্যালান রোবোক বলেন, “পরমাণু অস্ত্রের অস্তিত্ব মানেই এই অস্ত্র একদিন ব্যবহৃত হবে—এটি শুধুই সময়ের ব্যাপার। তাই আমাদের উচিত, আন্তর্জাতিকভাবে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিগুলোতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।”
২০১৯ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা এবং পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনার মাধ্যমে আমরা দেখেছি, একটি অল্প বিস্ফোরণও কিভাবে বৈশ্বিক সংকটের জন্ম দিতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাটি নিছক একটি কাল্পনিক দৃশ্যপট নয়- বরং এটি একটি সতর্কবার্তা, যা বিশ্বের সব পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এবং সাধারণ মানুষের মনে শান্তির প্রয়োজনীয়তা নতুন করে জাগিয়ে তোলে।
বিবিসে নিউজে প্রকাশিত ২০১৯ সালের প্রতিবেদনটি পড়ুন
What's Your Reaction?






