বেগম রোকেয়ার "সুলতানার স্বপ্ন": একটি সুন্দর সংসার।

বেগম রোকেয়ার "সুলতানার স্বপ্ন" উপন্যাসিকাটি এর সমালোচনা।

Dec 19, 2024 - 04:13
 0  22

বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা "মতিচুর" গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে আছে 'সুলতানার স্বপ্ন'। 'সুলতানার স্বপ্ন' গল্পে সুলতানা ভারতবর্ষের একজন নারী রূপে প্রতিনিধিত্ব করেছে। গল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে আছে সুলতানার ভগিনী সারা।

 

সুলতানা তার স্বপ্নের সূচনা নিম্নলিখিত ভাবে বর্ণনা করেছেন:

"একদা আমরা শয়নকক্ষে আরাম কেদারায় বসিয়া ভারতললনার জীবন সম্বন্ধে চিন্তা করিতেছিলাম আমাদের দ্বারা কি দেশের কোন ভাল কাজ হইতে পারে না? এই সব ভাবিতেছিলাম।... সহসা আমার পার্শ্বে একটি ইউরোপীয় রমণীকে দণ্ডায়মান দেখিয়া বিস্মিত হইলাম।... তাহাকে আমার পরিচিতা 'ভগিনী সারা' (Sister Sara) বলিয়া বোধ হইল। ভগিনী সারা 'সুপ্রভাত' বলিয়া আমাকে অভিবাদন করিলেন!"

 

সুলতানার স্বপ্নে দেখা দেয় তার ভগিনী সারা। তখন সারার সাথে কথকের পূর্বের স্মৃতিসমূহের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। দার্জিলিং অবস্থান কালে সুলতানা তার ভগিনী সারার সাথে ভ্রমণ করতেন। উদ্ভিদকাননে ভ্রমণের সময় তারা ফুলের লিঙ্গনির্ণয় সম্বন্ধে বেশ তর্ক-বিতর্ক করেছেন। ভগিনী সারা পুনরায় সুলতানাকে নতুন কোন স্থানে ভ্রমণে নিয়ে যাবার জন্য এসেছেন। কথক বিনা বাক্যব্যয়ে সারার সাথে বাহির হলেন।

 

ভ্রমণকালের বিবরণে কথক বলেছেন

"... রাজপথে লোকে লোকারণ্য! কি বিপদ! আমি দিনেরবেলায় এভাবে পথে বেড়াইতেছি। ইহা ভাবিয়া লজ্জায় জড়সড় হইলাম যদিও পথে একজনও পুরুষ দেখিতে পাই নাই।" মূলত ভারতবর্ষের মুসলমান নারীরা ঐ সময়ে ছিল অন্তঃপুরে। পর্দা ব্যতীত দিনের আলো দেখবার কোন অধিকার নারীর ছিল না বললেই চলে। সেখানে যখন সুলতানা তার স্বপ্নে ভ্রমণ কালে দিনেরবেলায় বিনা পর্দায় পথে বেড়িয়েছেন তখন লজ্জায় জড়সড় হয়ে যায়। ঐ সময় পথিকা স্ত্রীলোকেরা সুলতানাকে পুরুষভাবাপন্ন মনে করে। পুরুষভাবাপন্ন'র অর্থ সম্পর্কে ভগিনী সারা বলেছেন, "আপনাকে পরুষের মত ভীরু ও লজ্জানম্র দেখায়।" ভগিনী সারার অর্থ বিশ্লেষণ শুনে ভাতরবর্ষের লোক হিসেবে মনের অভ্যন্তরে প্রশ্ন জাগবে পুরুষ কি ভীরু? পুরুষ কি লজ্জানম্র? তাহলে কেমন করে ভগিনী সারা পুরুষদের ভীরু ও লজ্জানম্র বললেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ভগিনী সারার উত্তরে। তিনি বলেন, "এ দেশের নাম 'নারীস্থান' এখানে স্বয়ং পুণ্য নারীবেশে রাজত্ব করেন।" সুলতানা বা কথক কৌতূহল গোপন করিতে না পেরে ভগিনী সারাকে জিজ্ঞেস করেন, "পুরুষরা কোথায়?" প্রশ্নের উত্তরে ভগিনী সারা বলেন, "যেখানে তাদের থাকা উচিত সেইখানে, অর্থাৎ তাহাদের উপযুক্ত স্থানে।" কথক উপযুক্ত স্থানের অর্থ জানতে চাইলে সারা বলেন, "এ দেশের পুরুষজাতি গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ থাকে।" 

 

ঐ দেশে পুরুষজাতিকে গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ রাখার পিছনে আছে উদ্দীপনাপূর্ণ ঘটনা।! "কিছু বিদেশী লোক এ দেশে আসিয়া আশ্রয় লইল। সেই আশ্রয় নেয়া লোকদের রাজা মহারানীকে ঐ আসামী ধরিয়ে দিতে অনুরোধ করিলেন। মহারানী আশ্রিত হতভাগ্যদিগকে ক্রুদ্ধ রাজার নিকট ধরিয়ে দিলেন না। প্রবল ক্ষমতাশালী রাজা ত্রুোধান্ধ হয়ে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত হলেন।... এদেশের সেনাদল পশ্চাৎবর্ত্তী হইতে লাগিল এবং শত্রুগণ ত্রুমশ অগ্রসর হইল।... পরে দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডি প্রিন্সিপাল দ্বায়িত্ব নিলেন দেশ রক্ষার।"

 

দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডি প্রিন্সিপাল বললেন, "আমরা যুদ্ধযাত্রা করিবার পূর্বে পুরুষদের অন্তঃপুরে প্রবেশ করা উচিত। আমি পর্দার অনুরোধে এই প্রার্থনা করি।" মহারানী বলেন, "অবশ্য! তাহা ত হইবেই।" মহারানীর এই আদেশকে পুরুষরা ঈশ্বরের আশীর্বাদ মনে করে মহারানীকে ভক্তি করে অন্তঃপুরের পথে অনগ্রসর হয়েছেন। নারীরা মস্তিষ্ক বলে বিজয় অর্জন করেন। এমনকি আর কোন প্রতিবেশী রাজা এদেশে আক্রমণ করিতে আসেন নি। এভাবেই পুরুষরা ঐ দেশে অন্তঃপুরে থাকেন। 

 

"সুলতানার স্বপ্ন" গল্পে দেখা যায় যে, সুলতানা তার ভগিনী সারাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করেছেন। সেই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর পেয়েছেন। সেই প্রশ্ন-উত্তরে উঠে এসেছে ভারতবর্ষের নারী-পুরুষের জীবনযাত্রার সাথে "নারীস্থানের" জীবনযাত্রার পার্থক্য।

 

এবার আমরা একটি সুন্দর সংসারের দিকে আলোকপাত করি যেখানে স্ত্রীর কাজে স্বামী সাহায্য করবে আবার স্বামীর কাজে স্ত্রী সাহায্য করবে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে  নারীরা পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে কর্মে নিয়োজিত থাকেন। কোন কাজে এখন আর দেখা হয় না কে নারী, কে পুরুষ। দেখা হয় যোগ্যতা, দেখা হয় দক্ষতা। বর্তমানে যে সমস্যা দেখা যায় তা হলো সাংসারিক কাজের ক্ষেত্রে। সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত যে সকল সাংসারিক কাজ নারীদের। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় সারাদিন একজন পরুষের সমপরিমাণ কাজ করে আবার ঘরে এসে নারীকে ঘরের কাজ করতে হয়। নারীদের অবসর বলে কিছু থাকে না। এই প্রসঙ্গে উদাহরণ দেয়ার জন্য যথার্থ হবে গ্রামের প্রচলিত প্রবাদ,"জিরানোর সময় এই কচা গুলো লাগাইস।"(জিরানো- বিশ্রাম, কচা- গাছের ডাল বিশেষ) অর্থাৎ মালিক বলছে, শ্রমিক যখন বিশ্রাম নিবে তখন যেন গাছগুলো লাগায়। নারীরাও বর্তমানে ঐ শ্রমিকদের ন্যায় সারাদিন অফিস করে যখন ঘরে এসে বিশ্রাম নিবে তখন সাংসারিক কাজ করে। 

 

"সুলতানার স্বপ্ন" গল্পে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বলতে চেষ্টা করেছেন, "নরনারী উভয়ে একই সমাজ-দেহের বিভিন্ন অঙ্গ, পুরুষ শরীর, রমণী মন।" সংসারের যাবতীয় কাজে যদি কোন পুরুষ তার রমণীকে সহায়তা করেন তাহলে কিন্তু সেই সংসারে তথা সেই সমাজে কোন সমস্যা তৈরি হয় না। এরিস্টটলের একটি উক্তিতে এমন বলা আছে, "সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হলো শিক্ষা।" যদি পুরুষ তার রমণীকে সহায়তা করেন তাহলে সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করা যাবে। ফলশ্রুতিতে তৈরি হবে শিক্ষা। আর শিক্ষা কখনো নারী ও পুরুষের ভিতরে বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে না।

 

পুরুষরাও যদি গৃহের কাজে এগিয়ে আসে তাহলে নারীকে বেশি বেগ পেতে হবে না। নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে অসাধ্য সাধন করতে পারবে একথা বলতে দ্বিধা নেই। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন "সুলতানার স্বপ্ন"তে এমন দেশে সুলতানাকে নিয়ে গিয়েছেন সেখানে পুরুষরা অন্তঃপুরে থাকেন। এই অন্তঃপুরে থাকার মানে এমন হতে পারে- পুরুষরা নারীদের কাজে সাহায্য করে। আবার নারীরা যখন বাহিরে কাজ করে তখন এমন- নারীরা পুরুষের কাজে সাহায্য করে। মোটকথা সুন্দর সমাজ বা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন হলো সুলতানা স্বপ্ন।

 

~ মুহাম্মদ আল ইমরান।

নাট্যকলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow

MuhammadAlEmran Muhammad Al Emran (Bengali: মুহাম্মদ আল ইমরান) known as M A Emran, is a Bangladeshi actor, writer and filmmaker. মুহাম্মদ আল ইমরান এম এ ইমরান নামেও পরিচিত, একজন বাংলাদেশী লেখক অভিনেতা এবং নির্মাতা। তিনি বরিশাল বিভাগের সাগরকন্যা খ্যাত পটুয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।