পাহাড়ের কিছু ভিন্নতর স্বাদের জনপ্রিয় খাবার

পাহাড়ের খাবারগুলো স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকদের মাঝেও ব্যাপক জনপ্রিয় ও আর্কষণীয়।

Oct 28, 2024 - 17:20
Nov 15, 2024 - 11:33
 0  20
পাহাড়ের কিছু ভিন্নতর স্বাদের জনপ্রিয় খাবার
পাহাড়ের কিছু ভিন্নতর স্বাদের জনপ্রিয় খাবার

পাহাড়ের খাবারগুলোর স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগত গুণ ভিন্ন ধাঁচের হলেও এগুলো বেশ জনপ্রিয়। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে যেসব জনগোষ্ঠীর লোকজন বসবাস করেন, তাদের খাদ্যাভ্যাস ও রান্নার ধরণ দেশের সমতল অঞ্চলের মানুষের থেকে কিছুটা ভিন্ন। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর খাবারে প্রাকৃতিক ও সজীব উপকরণের ব্যবহার বেশি দেখা যায়, যা তাদের খাদ্যকে স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর করে তোলে। পাশাপাশি, পাহাড়ের খাবারগুলোতে সহজলভ্য স্থানীয় উপাদানের ব্যবহার হয়, যা ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির গভীর সংযোগকে তুলে ধরে।

আমরা পাহাড়ি অঞ্চলের কিছু জনপ্রিয় খাবার সম্পর্কে জানবো, যেগুলো শুধু সেখানে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে নয়, বরং পর্যটকদের মাঝেও ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়। চলুন, জেনে নেওয়া যাক পাহাড়ের জনপ্রিয় খাবার এবং তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো:

১. বাঁশ কোড়ল 
বাঁশ কোড়ল পার্বত্য অঞ্চলের জনপ্রিয় খাবারগুলোর মধ্যে একটি। এটি বাঁশের কচি অঙ্কুর থেকে তৈরি করা হয়। বাঁশের অঙ্কুর সংগ্রহ করে তা বিভিন্নভাবে রান্না করা হয়, যেমন ভর্তা, তরকারি বা আচার হিসেবে খাওয়া হয়। বাঁশ কোড়ল থেকে তৈরি খাবারগুলো বেশ পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু। এতে প্রচুর ফাইবার, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, এবং ভিটামিন থাকে, যা হজমে সহায়ক ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী।

বাঁশ কোড়লের স্বাদ একটু কটু এবং ঝাঁঝালো হয়, তবে পাহাড়ি মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

২. মাশরুম 
মাশরুম পার্বত্য অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় ও পুষ্টিকর খাবার। বিশেষত বর্ষাকালে পাহাড়ি বনাঞ্চলে প্রচুর মাশরুম জন্মায়, যা স্থানীয় জনগণ সংগ্রহ করে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। মাশরুম ভাজি, ভর্তা বা তরকারি হিসেবে খাওয়া হয়, এবং এটি সাদা ও বাদামি দুই ধরনেরই হতে পারে।

মাশরুমে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এটি হৃদরোগ প্রতিরোধ, ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করা, এবং কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। সহজলভ্যতা ও পুষ্টিগুণের কারণে এটি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার।

৩. চামফাং (বাঁশের মধ্যে রান্না করা খাবার)
চামফাং হচ্ছে একটি প্রাচীন রান্নার পদ্ধতি, যা বাঁশের ভিতরে খাবার রান্না করার মাধ্যমে তৈরি করা হয়। বিশেষত মাংস এবং মাছ রান্নার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। রান্নার জন্য বাঁশের একটি কচি অংশ কেটে তার মধ্যে মাংস, লবণ, মসলা, সবজি এবং পানি দিয়ে আগুনে ধীরে ধীরে রান্না করা হয়। 

এই পদ্ধতিতে রান্না করার ফলে খাবারে এক ধরনের বিশেষ সুগন্ধ তৈরি হয় এবং বাঁশের প্রাকৃতিক উপাদানগুলো খাবারে মিশে যায়, যা স্বাদের গুণগত মান বাড়িয়ে দেয়। চামফাং পদ্ধতিতে রান্না করা খাবার বেশ পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর। বাঁশের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রাকৃতিক গুণাগুণ খাবারকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।

৪. নাপ্পি
নাপ্পি হলো পাহাড়ি অঞ্চলের আরেকটি বিখ্যাত খাবার, যা ফার্মেন্টেড (গাঁজানো) মাছ দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি রান্নায় একটি বিশেষ মসলার মতো কাজ করে এবং অনেক তরকারির স্বাদ বাড়াতে ব্যবহার করা হয়। মূলত মাছকে লবণ দিয়ে ফার্মেন্ট করে দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা হয় এবং এটি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করা হয়।

ফার্মেন্টেড খাবারের ফলে নাপ্পি স্বাদে একটু তীব্র হয়, কিন্তু যারা পাহাড়ি খাবার পছন্দ করেন, তাদের কাছে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি ভাত, সবজি বা অন্যান্য তরকারির সাথে মিশিয়ে খাওয়া হয়।

৫. পাহাড়ি শাকসবজি এবং বন্য ফল
পাহাড়ি এলাকায় বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি এবং বন্য ফল পাওয়া যায়, যা স্থানীয় জনগণের খাদ্যতালিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাহাড়ের শাকসবজির মধ্যে আছে রাম আলু, হনাউলৌ, তারা সবজি, পুঁজি পাতা, কানাইডিঙ্গা, ঢেঁকি শাক, আদারফুল যা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও নিত্য খাবারের তালিকায় বেগুন, বরগটি, বাঁধাকপি ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন ধরনের বন্য ফল হিসেবে রক্তগোটা, লটকন, শাপলাইশ ফল, ডেউড়া ফল, কমল ফল, চিনাল ফল ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়। 

এই শাকসবজি ও ফলগুলো খুবই পুষ্টিকর এবং প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত হওয়ায় এর পুষ্টিগুণ অপরিসীম। পাহাড়ের মানুষেরা এসব শাকসবজি ও ফল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের রান্না এবং খাবার তৈরি করেন।

৬. জুম চাষের চাল
পাহাড়ি অঞ্চলে চাষ করা চাল, যা জুম চাল নামে পরিচিত। এটি খুবই সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। এই চাল দিয়ে তৈরি করা হয় বিশেষ ধরনের খাবার যা অনেক পর্যটকের মন কেড়ে নেয়। জুম চাষ হলো পাহাড়ি অঞ্চলের একটি বিশেষ ধরণের চাষাবাদ পদ্ধতি, যেখানে পাহাড়ি ঢালে কৃষকরা ধানসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করেন। এছাড়া পাহাড়ি অঞ্চেলের আরো বেশ কিছু চাল রয়েছে যেমন - বঙ্গা চাল, মিঝু চাল, বাইরিং চাল, কুম্বি চাল, কামারাং চাল, কাউন চাল, হবরক ধান ইত্যাদি। 


পাহাড়ি খাবারগুলো একদিকে যেমন ঐতিহ্যের অংশ, অন্যদিকে তেমনি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি ও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিফলন। প্রাকৃতিক উপাদান ও স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে প্রস্তুতকৃত এই খাবারগুলো সারা দেশের মানুষের কাছে বেশ আকর্ষণীয়। পাহাড়ে ভ্রমণ করার সময় এসব খাবারগুলো অবশ্যই খেয়ে দেখা উচিত, কারণ এতে শুধু স্বাদ উপভোগ করাই নয়, সেই সাথে পাওয়া যাবে পাহাড়ি সংস্কৃতির ঘ্রাণ।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow