নোবেল পুরস্কারের ইতিহাস, মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও ক্যাটাগরিসমূহ
নোবেল পুরস্কার হলো পৃথিবীর সর্বাধিক সম্মানজনক পুরস্কার। চলুন জেনে নিই এর ইতিহাস, মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও ক্যাটাগরিসমূহ।
নোবেল পুরস্কার মানবজাতির অগ্রগতি ও কল্যাণের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পৃথিবীর সর্বাধিক সম্মানজনক পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। বিজ্ঞান, সাহিত্য, এবং শান্তির জন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। আলফ্রেড নোবেল, একজন সুইডিশ বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক, এই পুরস্কারের প্রবর্তক। তার ইচ্ছার ভিত্তিতেই ১৯০১ সালে প্রথমবারের মতো নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়।
আলফ্রেড নোবেল এর পরিচিতি
১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর সুইডেনের স্টকহোমে জন্মগ্রহণ করা আলফ্রেড নোবেল ছিলেন একজন প্রখ্যাত রসায়নবিদ, প্রকৌশলী এবং উদ্ভাবক। তিনি ডিনামাইট আবিষ্কারের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত, যা একদিকে নির্মাণ শিল্পে বিপ্লব ঘটায়, অন্যদিকে ধ্বংসাত্মকভাবে ব্যবহারের কারণে তার জীবনে অনেক বিতর্কের জন্ম দেয়। নোবেলের পেশাগত সাফল্য তাকে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল করেছিল, কিন্তু তার নিজের আবিষ্কারকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখে তিনি গভীরভাবে ব্যথিত হন।
১৮৮৮ সালে তার ভাই লুডভিগ নোবেলের মৃত্যুর পরে ফ্রান্সের একটি পত্রিকায় ভুলবশত আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুর খবর ছাপেন। ওই সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল, “The Merchant of Death is Dead”। এ খবর পড়ে নোবেল বিচলিত হন এবং তিনি উপলব্ধি করেন যে, তার মৃত্যুর পরে মানুষ তাকে কীভাবে স্মরণ করবে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তার সম্পত্তি যেন মানবজাতির কল্যাণে ব্যবহৃত হয়। এরপরই তিনি তার ইচ্ছাপত্র তৈরি করেন, যেখানে তিনি তার সম্পদের একটি বড় অংশ নোবেল পুরস্কার প্রবর্তনের জন্য রেখে যান।
নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তন
১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর আলফ্রেড নোবেল তার সম্পত্তির একটি বড় অংশ দিয়ে নোবেল পুরস্কার চালু করার ঘোষণা দেন। তার ইচ্ছা অনুযায়ী, পুরস্কার প্রদান করা হবে তাদের যারা “বিগত বছরে মানবজাতির সর্বাধিক কল্যাণে অবদান রেখেছে।” নোবেল তার ইচ্ছাপত্রে পাঁচটি ক্ষেত্রে পুরস্কার প্রদানের কথা উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে, অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কারও চালু করা হয়, যা আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছাপত্রের অংশ ছিল না।
প্রথম নোবেল পুরস্কার ১৯০১ সালে প্রদান করা হয়। পুরস্কারের জন্য অর্থ দেওয়া হয় নোবেলের বিপুল সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত সুদ দিয়ে, যা তিনি তার ইচ্ছাপত্রে নির্ধারণ করেছিলেন। নোবেল কমিটি এই পুরস্কারগুলোর জন্য মনোনয়ন গ্রহণ করে এবং বিজয়ী নির্ধারণ করে।
নোবেল পুরস্কারের ক্যাটাগরিসমূহ
নোবেল পুরস্কার মূলত পাঁচটি ক্যাটাগরিতে প্রদান করা হয়: পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য এবং শান্তি। প্রতিটি পুরস্কারই বিশেষভাবে মানবজাতির উন্নতির জন্য অবদান রাখার উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়।
১. পদার্থবিজ্ঞান
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার সেই সব বৈজ্ঞানিকদের জন্য প্রদান করা হয়, যারা পদার্থবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রাখেন। ১৯০১ সালে, জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম কনরাড রন্টজেন প্রথম পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান তার এক্স-রে আবিষ্কারের জন্য। এই আবিষ্কারটি চিকিৎসাশাস্ত্রে বিপ্লব ঘটায়।
২. রসায়ন
রসায়নে নোবেল পুরস্কার রসায়নবিদদের উদ্ভাবনমূলক এবং গবেষণাধর্মী কাজের জন্য প্রদান করা হয়। ১৯০১ সালে, ডাচ রসায়নবিদ জ্যাকবস হেনরিকাস ভ্যান্ট হফ রসায়নে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তার অবদান রসায়নের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়।
৩. চিকিৎসাবিজ্ঞান
চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার মেডিসিন বা বায়োলজির ক্ষেত্রে অসাধারণ আবিষ্কার বা গবেষণার জন্য প্রদান করা হয়। ১৯০১ সালে, জার্মান বিজ্ঞানী এমিল ভন বেহরিং এই ক্যাটাগরিতে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ডিপথেরিয়া প্রতিরোধে যে ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেন, তা অসংখ্য মানুষের জীবন রক্ষা করে।
৪. সাহিত্য
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার সেইসব লেখককে প্রদান করা হয়, যাদের সাহিত্যকর্ম মানবতার কল্যাণে অসামান্য অবদান রাখে। ১৯০১ সালে, ফ্রেঞ্চ লেখক সুলি প্রুধোম প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
৫. শান্তি
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রদান করা হয়, যারা মানবজাতির শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছেন। এই পুরস্কারটি আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছার মূল উদ্দেশ্যকে প্রতিফলিত করে। প্রথম শান্তি পুরস্কার জয়ী ছিলেন জিন হেনরি ডুনান্ট এবং ফ্রেডরিক প্যাসি, যারা মানবাধিকারের প্রতি নিবেদিত ও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
৬. অর্থনীতি
১৯৬৮ সালে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক Sveriges Riksbank আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার প্রতিষ্ঠা করে। প্রথম এই পুরস্কার প্রদান করা হয় ১৯৬৯ সালে, যা জন আর হিকস এবং র্যাগনার ফ্রিস্ক ভাগাভাগি করে নেন।
নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন প্রক্রিয়া
নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত গোপনীয় ও কৌশলী। মনোনয়নের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিরা বিশ্বব্যাপী প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ, গবেষক এবং অধ্যাপক হয়ে থাকেন। নোবেল কমিটি সংশ্লিষ্ট ক্যাটাগরির জন্য মনোনয়ন প্রস্তাব গ্রহণ করে, যা একাধিক ধাপে পর্যালোচনা করা হয়। প্রতিটি বিভাগের জন্য একটি বিশেষ কমিটি দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকে, যা মনোনীতদের পরীক্ষা করে এবং বিজয়ী নির্ধারণ করে।
পুরস্কার ঘোষণার আগে পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়, এবং বিজয়ীদের নামমাত্রই প্রকাশ করা হয়। পুরস্কার বিজয়ীরা একটি বিশেষ স্বর্ণপদক, একটি ডিপ্লোমা, এবং পুরস্কারের অর্থমূল্য পেয়ে থাকেন।
নোবেল পুরস্কারের মূল্য
প্রতিটি নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য বেশ উল্লেখযোগ্য। যদিও আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুকালে তার মোট সম্পত্তির মূল্য প্রায় ৩১ মিলিয়ন ক্রোনা ( সুইডেনের মুদ্রা ) ছিল, বর্তমানে এটি একটি বৃহৎ তহবিলে পরিণত হয়েছে। পুরস্কারের অর্থমূল্য সাধারণত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় এবং ২০২০ সালের পর থেকে প্রতিটি পুরস্কারের মূল্য প্রায় ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিতর্ক ও সমালোচনা
নোবেল পুরস্কার সাধারণত সম্মানের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত হলেও, কিছু সময়ে বিতর্ক ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার নিয়ে অনেক সময় বিতর্ক সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৭৩ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসানের জন্য হেনরি কিসিঞ্জার ও লে ডুক থো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান, কিন্তু লে ডুক থো এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। এছাড়া, ১৯৯৪ সালে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইজাক রবিন, শিমন পেরেজ এবং প্যালেস্টাইনের নেতা ইয়াসির আরাফাত শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান, যা বিশ্বজুড়ে বিতর্কের জন্ম দেয়।
নোবেল পুরস্কার শুধু একজন ব্যক্তির কৃতিত্বের জন্য নয়, বরং মানবতার সেবা এবং কল্যাণে নিবেদিত প্রচেষ্টার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক। মানবজাতির উন্নতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় যারা কাজ করছেন, তাদের অনুপ্রেরণা হিসেবে নোবেল পুরস্কার যুগ যুগ ধরে কাজ করে যাচ্ছে।
এই ধরনের আরো কন্টেন্ট পড়ুন
What's Your Reaction?