নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ৫ নভেম্বর থেকে খুলছে খাগড়াছড়ির পর্যটনকেন্দ্র
খাগড়াছড়িতে পর্যটকদের জন্য ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। আগামী ৫ নভেম্বর থেকে পর্যটকরা খাগড়াছড়ির পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ভ্রমণ করতে পারবেন।
গত ২৯ অক্টোবর খাগড়াছড়ি জেলার পর্যটন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান। দীর্ঘ এক মাসেরও বেশি সময় পর জেলাটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় আগামী ৫ নভেম্বর থেকে খাগড়াছড়ির পর্যটন কেন্দ্রগুলো আবারও খুলে দেওয়া হবে।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সাম্প্রতিক সহিংসতার কারণে পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে খাগড়াছড়ি ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। জেলা প্রশাসকের মতে, বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত হয়ে আসায় পর্যটকদের জন্য নতুন করে বিপদের সম্ভাবনা নেই, তাই ভ্রমণের সকল বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কেন এই নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়?
২০২৪ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উপজেলায় পাহাড়ি এবং বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। দ্বন্দ্বের কারণে রাঙ্গামাটি জেলা শহরেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে, এবং প্রশাসনের কঠোর অবস্থানেও এই পরিস্থিতি কিছুতেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। পরে, ১ অক্টোবর খাগড়াছড়ি শহরের আরো একটি ঘটনায় এক শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
এই ঘটনার ফলে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে, এবং জনমনে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়। পরিস্থিতির অবনতি দেখে জেলা প্রশাসন পর্যটকদের নিরাপত্তার কথা ভেবে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত খাগড়াছড়ি ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
পর্যটনের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত এলাকা হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর দেশ-বিদেশের অনেক পর্যটক এর পাহাড়ি ভৌগোলিক বৈচিত্র্য, ঝর্ণা, আদিবাসী সংস্কৃতি এবং সবুজ শ্যামল পরিবেশ উপভোগ করতে আসেন। নিষেধাজ্ঞার ফলে স্থানীয় পর্যটন শিল্পে অনেকটা ভাটা পড়ে, বিশেষ করে যে সকল ব্যবসায়ী এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পর্যটকদের নির্ভর করে ব্যবসা পরিচালনা করেন তারা বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হন।
এই নিষেধাজ্ঞার ফলে শুধুমাত্র ব্যবসা-বাণিজ্য নয়, খাগড়াছড়ির সাংস্কৃতিক বিনোদন সেক্টরেও ব্যাপক প্রভাব পড়ে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অনেকেই পর্যটন নির্ভর ব্যবসার মাধ্যমে তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। হোটেল, রিসোর্ট, এবং স্থানীয় পর্যায়ে গাইড বা ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের মালিক এবং কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েন। এছাড়া নিষেধাজ্ঞার ফলে পর্যটকদের আগমনে দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থবিরতা দেখা দেয় এবং পর্যটন শিল্পের অপূরণীয় ক্ষতি হয়।
বর্তমান পরিস্থিতি এবং জেলা প্রশাসনের আশাবাদ
বর্তমানে খাগড়াছড়ির পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরেছে। স্থানীয় প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর প্রচেষ্টায় জেলায় শান্তি ফিরে এসেছে বলে জানা যায়। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকায় আমরা পর্যটন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে যাচ্ছি। আশা করি, এই সিদ্ধান্তে পর্যটকরা আবারও খাগড়াছড়ি ভ্রমণ করতে আগ্রহী হবেন এবং স্থানীয় পর্যটন শিল্প আবারও উন্নতির দিকে যাবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলিতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।
জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র
খাগড়াছড়ি জেলায় অনেক আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে, যা দেশের ভ্রমণপ্রেমীদের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই অঞ্চলের পাহাড়ি সৌন্দর্য, হ্রদ, জলপ্রপাত, এবং আদিবাসী সংস্কৃতি পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। কিছু জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে রিছাং ঝর্ণা, আলুটিলা গুহা, এবং দেবতার পুকুর। এছাড়াও জেলা শহরটি বিভিন্ন আদিবাসী বাজার এবং ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত, যা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের নজর কাড়ে।
আলুটিলা গুহা খাগড়াছড়ির অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান, যা একটি প্রাকৃতিক চুনাপাথরের গুহা। রিছাং ঝর্ণার শীতল জলপ্রপাত এবং সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের মনকে বিমোহিত করে। তাছাড়া, স্থানীয় আদিবাসী বাজারগুলো পর্যটকদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণীয় স্থান, যেখানে বিভিন্ন ধরনের হস্তশিল্প এবং আদিবাসী পোশাক পাওয়া যায়।
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের প্রভাব
এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ফলে খাগড়াছড়ি জেলার পর্যটন খাত আবারও সজীব হয়ে উঠবে বলে মনে করা হচ্ছে। পর্যটকদের আগমনের মাধ্যমে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আয় রোজগারের সুযোগ বাড়বে এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলো আগের চেয়ে আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে। নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ফলে দেশের অন্যান্য পর্যটন শহরগুলোর মতো খাগড়াছড়িও আবারও দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে আনন্দিত এবং তারা আশা করছেন যে সামনে পর্যটকদের বড় স্রোত আসবে। বিভিন্ন হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, এবং পরিবহন সেবাদানকারী সংস্থাগুলি ইতিমধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে পর্যটকদের স্বাগত জানাতে।
পর্যটকদের জন্য জেলা প্রশাসনের কিছু নির্দেশনা
পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি শান্ত না হওয়ায় পর্যটকদের ভ্রমণকালে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। পর্যটকদের ভ্রমণকারীদের দলের সাথে একসাথে থাকার জন্য এবং নির্দেশনা অনুসরণ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রশাসন বলেছে যে, বিশেষ করে আলুটিলা, রিছাং ঝর্ণা, এবং দূরবর্তী পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে ভ্রমণ করার সময় নিরাপত্তার কথা মাথায় রাখতে হবে।
পর্যটকদের জন্য খাগড়াছড়ির দরজা আবারও খুলে দেওয়া হচ্ছে—এটি শুধু স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য নয়, দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য একটি শুভ সংবাদ। খাগড়াছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আবারও এখানে আসবেন, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতির জন্য সহায়ক হবে।
What's Your Reaction?