জলবায়ু পরির্তনের প্রভাব এবং করণীয়

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ বর্তমান বিশ্বে খুবই একটি আলোচিত বিষয়। এর প্রভাবে...

Oct 29, 2024 - 17:44
Nov 12, 2024 - 16:21
 0  12
জলবায়ু পরির্তনের প্রভাব এবং করণীয়
জলবায়ু পরির্তনের প্রভাব এবং করণীয়

জলবায়ু কী?
জলবায়ু পরিবর্তনের কারন বর্তমান বিশ্বে খুবই একটি আলোচিত বিষয়। জলবায়ু হল কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকার ৩০-৩৫ বছরের গড় তাপমাত্রা পরিবর্তনের হিসাব।এই জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে পৃথিবীর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বৈশ্বিক উষ্ণতা বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং নামে পরিচিত।  একে বৈজ্ঞানিক ভাষায় গ্রিন হাউস এফেক্ট ও বলা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পৃথিবীতে নানা ধরনের দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে যেমন:- অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, আকস্মিক বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় প্রভৃতি। যার ফলশ্রুতিতে বহু জীবনহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমগ্র বিশ্বের প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে।এর ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আবহাওয়ার ঋতুচক্রের ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারন:
জলবায়ু পরিবর্তনের কারন প্রধানত দুই প্রকার, যথা:- (১) প্রাকৃতিক কারণ(২) মনূষ্য সৃষ্ট কারণ

(১) প্রাকৃতিক কারণসমূহ
ক. মহাদেশীয় ড্রিফট খ. আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত গ. পৃথিবীর গতি পরিবর্তন ঘ. সামুদ্রিক স্রোত ঙ. ঘূর্ণিঝড়

উপরোক্ত প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন সমূহ প্রকৃতি তার আপন নিয়মে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা প্রসমিত করে থাকে।

(২) মনুষ্য সৃষ্ট কারণসমূহ
ক. কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ  নির্গমন বৃদ্ধি /কার্বন নিঃসরণ খ. খনিজ বা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার গ. বাতাসে নাইট্রাস অক্সাইড বৃদ্ধি ঘ. পাহাড় নিধন ঙ. বনভূমি উজাড়

প্রাণীকূলের মধ্যে মানুষ হল সবচেয়ে বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন প্রাণী। অন্য প্রাণীদের মতো প্রকৃতির খামখেয়ালীকে সে মেনে নিতে পারে না। তাই আধুনিক মানুষ প্রকৃতির ওপরে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে নিজের জীবনকে করে তুলেছে সুখ-স্বাছন্দ্যময়।  আধুনিক মানুষের সৌখীন কার্যকলাপের কারণেই পৃথিবীকে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক  উষ্ণ করে ফেলছে ।এক কথায় গ্রীন হাউজ ইফেক্ট হচ্ছে।

গ্রীনহাউজ ইফেক্ট কি ?
মানুষ তার দৈনন্দিন চাহিদা মিঠানোর জন্য প্রতিনিয়ত শিল্প কারখানায়, যানবাহনে, কৃষি ফার্মে জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়াচ্ছে। এই জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে  গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত নিঃসরণ হচ্ছে। ফলে  সাম্প্রতিক কালে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।  সূর্যের রশ্মি স্থলভাগ, জলভাগ  ও বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত করে। এই তপ্ত স্থান গুলো যখন ঠাণ্ডা হতে থাকে, তাদের শোষিত তাপ বিকিরিত হয়ে সাধারণত ইনফ্রারেড রশ্মি হিসেবে বায়ুমণ্ডলে ফিরে যায়। বায়ুমন্ডলের  কিছু গ্যাসীয় উপাদান ও পদার্থ  কণা এই বিকিরিত তাপ শুষে নিজে ধারণ করে ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকা বায়ুস্তর অর্থাৎ ট্রপোস্ফিয়ারকে উষ্ণ করে তোলে।  বায়ুমন্ডলের এই উষ্ণায়নকে বলে গ্রিনহাউস ইফেক্ট। জলীয়বাষ্প, কার্বন ডাই অক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ওজন, ক্লোরোফ্লুরোকার্বন ইত্যাদি বায়বীয় পদার্থ তাপ শোষণ ও ধারণের ক্ষেত্রে জরুরি ভূমিকা পালন করে বলে এদেরকে ‘গ্রিনহাউস গ্যাস’ নামে ডাকা হয়।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন, যানবাহন চলাচল ও শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের জন্য যথেচ্ছভাবে পোড়ানো হচ্ছে কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও জীবাশ্ম  জ্বালানি।ফলে বায়ুমণ্ডলে তাপশোষী কিছু গ্রিনহাউজ গ্যাস ও কার্বন কণার নির্গমন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। । মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করতে  কৃষিকাজ, পশুচারণ, নগরায়নসহ নানা উদ্দেশ্যে বন কেটে উজাড় করা হচ্ছে। অপরদিকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার মতো বনাঞ্চলের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে কমছে।  এভাবেই  স্বাভাবিকের চেয়ে একটু একটু করে বেড়ে চলেছে বায়ুমণ্ডলের গড় উষ্ণতা। ইহাকেই এক কথায় বলা হয় বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং।

বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব:
গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাবে আগের তুলনায় ঘনঘন সামুদ্রিক ঝড় হচ্ছে। পৃথিবীর শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে আগের চেয়ে বেশি বৃষ্টি ও বৃষ্টিজনিত বন্যা হচ্ছে। অন্যদিকে আর্দ্র অঞ্চলগুলো হয়ে পড়ছে আগের চেয়ে শুষ্ক। এ ধরনের পরিবর্তনগুলোকে এক কথায় বলা হয় জলবায়ু পরিবর্তন।বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মেরু অঞ্চলের বরফস্তর বা হিমালয়-আল্পসের মতো পর্বতমালার হিমবাহ অথবা সমুদ্রে ভাসমান বরফের বিশাল খণ্ডগুলো গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপকূলীয় নিচু এলাকাগুলো নোনাপানির নিচে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। ফলে অনেক জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। যার কারনে মানুষ  তার বাসস্থান, কৃষিজমি ও নিরাপত্তা হারাচ্ছে।

বাংলাদেশে জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব:
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। সমুদ্রের নিকটবর্তী ভৌগোলিক অবস্থান, মাত্রাতিরক্ত জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদের অপ্রতুলতা এবং অধিক নির্ভরশীলতা ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের বিপন্নতা খুবই ভয়ানক।

সমুদ্রের লোনাপানি মিঠা পানি নদী ও জলাশয়ে প্রবেশ করেছে।যার ফলে মিঠা পানির উৎস কমে যাচ্ছে ও মিঠাপনি  অঞ্চলের জীব বৈচিত্র্য হুমকীর মুখে পড়ছে।

বিগত চার দশকে ভোলা দ্বীপের প্রায় তিন হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে গেছে।জলবায়ু বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্ট বলা হয় ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মি. উঁচু হলে, বাংলাদেশের মোট আয়তনের ১৮.৩ অংশ সাগরের নীচে তলিয়ে যাবে।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সূত্র অনুসারে রাজশাহীর উচ্চ বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯১ সনে পানির স্তর ছিল ৪৮ ফুট, ২০০০ সনে তা নেমে গিয়ে ৬২ ফুট এবং ২০০৭ সনে তা নেমে যায় ৯৩.৩৪ ফুটে।

স্বাভাবিক বন্যায় যেখানে দেশের মোট আয়তনের প্রায় ২০ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হতো বর্তমানে বন্যার সংখ্যা ও তীব্রতা দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে।আকস্মিক বন্যার কারনে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রায় ৪ হাজার বর্গকিলোমিটার ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের ১ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা এ ক্ষতি হয়।

বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়েছে। যার ফলে ২০০৭ সনের ১৫ নভেম্বর প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোন সিডর আক্রমণ করে ব্যাপক জান-মালের ক্ষয় ক্ষতি করে।এর মাত্র দুই বছরের মধ্যে আবার শক্তিশালী সাইক্লোন নার্গিস ও আইলা এবং ২০১৩ সনে মে মাসে মহাসেন আঘাত হেনে দেশের কৃষিকে বিপর্যস্থ করে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। যার কারনে বজ্রপাতে বহু লোকের প্রাণ হানি ঘটছে।

আমাদের করণীয়:
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব রোধ করার জন্য আমরা দুই ভাবে করনীয় নির্ধারন করতে পারি। যেমন:- (১)Adaptation (অভিযোজন), (২) Mitigation (প্রশমন)

(১) Adaptation (অভিযোজন):
জলবায়ুর এ বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য যে বিভিন্ন কৌশল রপ্ত করা হয়  তাকে Adaptation(অভিযোজন) বলে।যেমন:-

খরা, বণ্যা ও লবণ সহিষ্ণু কৃষি বীজ উৎপাদন করে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা ঝুঁকি কমানো।
গরম বা ঠাণ্ডা প্রতিরোধী উপাদান দিয়ে বাড়ি বানানো যাতে বাড়িতে গরম বা ঠান্ডা কম অনুভুত হয়।
(২) Mitigation (প্রশমন):
জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য যে সব কৌশল, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও নিরোধ করা হয় তাকে Mitigation (প্রশমন) বলে। যেমন:-

জীবাশ্ম জ্বালানী হ্রাস করার জন্য বিমান ভ্রমণ ও গাড়ির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সাইকেল বা নবায়নযোগ্য জ্বালানী নির্ভরতা বৃদ্ধি করা।
মিথেন গ্যাস উৎপাদন হ্রাস করার জন্য মাংস এবং দুগ্ধজাত খাবার কমানো ।
বনাঞ্চল ধ্বংসের কারণে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের নির্গমন বাড়ছে।তাই বনাঞ্চল ধ্বংস না করা।
গাছপালা কার্বন ধরে রাখে। ফলে, সেই গাছ যখন কাটা হয় বা পোড়ানো হয়, সঞ্চিত সেই কার্বন বায়ুমণ্ডলে নিঃসরিত হয়। তাই বায়ু মন্ডলে কার্বন নিঃসরন কমাতে বেশি বেশি গাছ লাগানো।
এয়ার কন্ডিশন ফ্রীজ এর ব্যবহার কমানো।
রাসায়নিক সার কীট নাশক এর পরিবর্তে জৈব সার ও জৈব বালাই নাশক ব্যবহার বৃদ্ধি করা।
ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যাবহার কমিয়ে ভূ-পৃষ্টের পানিকে ব্যবহারের উপযোগী করা।
প্লাস্টিক পণ্যের যত্র-তত্র ব্যবহার হ্রাস করে সহজে পচনশীল পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধি করা।
পরিশেষে, জলবায়ু পরিবর্তন রোধে মানুষ কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে তা প্রতিটি মানুষকে জানা দরকার। এবং সেই অনুসারে এখন থেকেই প্রতিটি মানুষকে উপরোক্ত পদক্ষেপ সমুহ গ্রহন করা উচিত।

What's Your Reaction?

like

dislike

love

funny

angry

sad

wow