পাড়াবন কি? পরিবেশ রক্ষায় পাড়াবনের ভূমিকা ?
পাড়াবন হলো গ্রাম বা পাড়ার আশে পাশে সুবিধাজনক একটি জায়গা চিহ্নিত করে যে বন সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয় সেটাই পাড়াবন পাড়াবন জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খুবিই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
পাড়াবন কি?
পাড়াবন হলো গ্রাম বা পাড়ার আশে পাশে সুবিধাজনক একটি জায়গা চিহ্নিত করে যে বন সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয় সেটাই পাড়াবন। পাড়াবন জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় খুবিই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।অনেক ক্ষেত্রে মৌজা ভিত্তিক এই বন সংরক্ষনের উদ্যোগ নেয়া হয় বলে মৌজা বন বা রিজার্ভ বন নামেও ডাকা হয়। গবেষকেরা ঐতিহ্যগত পাড়াবনকে নাম দিয়েছেন গ্রামীণ সাধারণ বন (ভিলেজ কমন ফরেস্ট বা ভিসিএফ)। পাড়াবনের আয়তন কত হতে হবে এর কোন বাধ্যবাধকতা নেই। মৌজা বনে সাধারণত কোন চারা গাছ রোপন করা হয় না। প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে ওঠা গাছ গাছালি সংরক্ষণ করে এই বন সৃজন করা হয়। পাড়াবনে গর্জন, গামারি, চিবিট, বহেরা, চাপালিশ, ডুমুর, গুটগুটিয়া স্থানীয় গাছ প্রাকৃতিক ভাবে বাড়তে থাকে।এই বন থেকে গ্রাম বাসীরা গ্রামের বিভিন্ন সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানে কিংবা কারো মৃত্যু হলে যে গাছবাঁশের প্রয়োজন হলে সেখান থেকে সংগ্রহ করে থাকে।
পাড়াবন সংরক্ষণের জন্য ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ৪১ (এ) ধারায় সংশ্লিষ্ট মৌজা প্রধানকে দায়িত্হব প্রদান করা হয়েছে। প্রত্যেকটি মৌজায় কমপক্ষে ১ থেকে ১০০ একর বা তার চেয়েও অধিক পরিমাণ পাড়া-বন রয়েছে। তিন পার্বত্য জেলার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বমসহ ১১টি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই পাড়ার আশপাশের প্রাকৃতিকবনগুলো যুগযুগ ধরে সংরক্ষণ করে আসছে।
পাড়াবন রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য লিখিত বা অলিখিত আকারে একটি পরিচালনা কমিটি থাকে।এই পরিচালনা কমিটিই পাড়াবনের সম্পদের ব্যবহার কিভাবে হবে তা নির্ধারণ করে। কোন কোন সম্পদ আহরন করা যাবে কোন সম্পদ আহরণ করা যাবে না তা কমিটি কতৃক নির্ধারন করা হয়।কেউ এই নিয়ম ভঙ্গ করলে শাস্তি ও জরিমানার বিধান রাখা হয়।
বন ও বাগানের মধ্যে পার্থক্য:
বন হলো প্রকৃতির সৃষ্টি। বাগান হলো মানুষের সৃষ্টি।
বাগনে কেবল দুএক প্রজাতির গাছপালা থাকে। বনে নানাপ্রজাতির গাছ-গাছালী থাকে।
বনে নানা ধরনের খাবার ও ফল-মূল পাওয়াযায়। বনে কেবল দু-এক প্রকারের খাবার পাওয়া যায়।
বন জীব-বৈচিত্র্য রক্ষা করে। বাগান জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস করে।
বন পানির উৎসকে সংরক্ষণ করে। বাগান পানির উৎসকে বিনষ্ট করে।
বনে হরেক রকমের ঔষধী গাছ পাওয়া যায়, যা বাগানে পাওয়া যায়না।
পরিবেশ রক্ষায় পাড়া বনের ভূমিকা:
পানির উৎস (ওয়াটারশেড) রক্ষা করে:
পাড়াবনে সুউচ্চ থেকে মাঝারী উচ্চতার গাছ আর লতাগুল্মের পত্রপল্লবে আচ্ছাদিত থাকায় মাটিতে সূর্যের আলো সহজে পৌঁছাতে পারে না।ফলে বৃষ্টির পানি মাটি থেকে সহজে বাস্পে পরিনত হতে পারে না।যার ফলে পাড়াবন পানির উৎস সমুহে সারা বছর পানি ধরে রাখে।
পাড়াবন জীব-বৈচিত্র্য (ইকোসিস্টেম) রক্ষা করে:
পাড়াবনে বিভিন্ন ধরনের ফলমূলের গাছ থাকায় বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখি,কীট-পত্ঙ্গ এসে বসবাস করে। বনের বিভিন্ন ফলমূল পশুপাখিরা খেয়ে সেগুলোর বীজ অন্য এলাকায় বিষ্টার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। ফলে নতুন নতুন বনভূমির সৃষ্টি হয়।
প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী:
মানুষের চাহিদা পূরণ করতে কল-কারখানায়, যানবাহনে, কৃষি ফার্মে জীবাশ্ম জ্বালানী প্রতিনিয়ত পোড়ানো হচ্ছে। এই জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর ফলে বায়ুমন্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত নিঃসরণ হচ্ছে। যার ফলে সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা অধিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন-মনোঅক্সাইড মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড, ওজন, ক্লোরো-ফ্লুরোকার্বন ইত্যাদি বায়বীয় পদার্থ তাপ শোষণ ও ধারণ করে। ফলে সেূর্যের তাপ শোষন বায়ু মন্ডলকে উত্তপ্ত করতে এই গ্যাসসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।পাড়াবনের গাছপালা বায়ু মন্ডল থেকে এই সব দুষিত গ্যাসকে শোষণ করে বায়ু মন্ডলের তাপমাত্রা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
পাড়াবনের অর্থনৈতিক অবদান:
গ্রামবাসীরা ঘরবাড়ি নির্মাণের প্রধান উপাদান বাঁশ, গাছ পাড়াবন থেকে পরিমিত আকারে সংগ্রহ করতে পারে। এছাড়া গ্রামে যারা বেত শিল্প এবং কবিরাজী কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে তারা সীমিত আকারে পাড়াবন থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করে অর্থ উপার্জন করতে পারে। এছাড়া বনমুরগি, বন্য শুকর, হরিণসহ নানা প্রজাতির পশু, পাখি ও কীটপতঙ্গ পাড়াবনে পাওয়া যায়। ফলে স্থানীয় গ্রামবাসীরা পাড়াবন থেকে আমিষের চাহিদা পূরণ করতে পারে।
উল্লেখ্য, প্রতিটি পাড়াবনকে ২০২১ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উদ্ভিদ ও প্রাণবৈচিত্র্যের আধার হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় পাড়াবনগুলো বন্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল ও উদ্ভিদ সংরক্ষণাগারে রপান্তর হয়েছে। সেখানে ৩৬৯ প্রজাতির বন্য প্রাণী ৫৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ ও ১৬৩ প্রজাতির বৃক্ষ পাওয়া গেছে। পাড়াবনগুলিতে বিলপ্তপ্রায় প্রজাতির নীলগলা গিরগিটি, মায়াহরিণ, ভারতীয় পেঙ্গুলিন, লেঙ্গুর, বড় আকারের কালো কাঠবিড়ালিসহ আরও অনেক প্রজাতির প্রাণীও পাওয়া গেছে।
তিন পার্বত্য জেলায় ৩৮৫টি পাড়ায় এ রকম পাড়াবন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রাঙামাটিতে ১৬২টি, বান্দরবানে ১৬১টি ও খাগড়াছড়িতে ৬২টি পাড়াবনে ৪৫ হাজার ৬ একর প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রয়েছে।
পাড়াবন রক্ষায় হুমকী সমূহ:
আজ থেকে ৪০ থেকে ৪৫ বছর আগে প্রতিটি পাহাড়ি পাড়াতেই পাড়াবন ছিল । কিন্তু বিভিন্ন কারণে পাড়াবন সংরক্ষণ করা বর্তমানে হুমকীর মধ্যে রয়েছে। সেগুলো হল যেমন:- জনসংখ্যার ক্রমর্ধমান চাপ। সামগ্রীক স্বার্থের পরিবর্তে ব্যাক্তি স্বার্থের প্রাধান্য।স্থানীয় কিংবা আন্তর্জাতিক বাজারে বনজ সম্পদের চাহিদা বৃদ্ধি। ফলে বনজ সম্পদ দেশ বিদেশে পাচার করে এক শ্রেণীর মানুষ বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। এদিকে বনজ সম্পদ নির্বিচারে ধ্বংস করছে।
পরিশেষে, বর্তমান বিশ্বে গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা একটি অত্যন্ত আলোচিত বিষয়। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারনে বিশ্বব্যাপি প্রাকৃতিক দুর্যোগে আজ মানব সভ্যতা বিপর্যস্ত। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমাতে হলে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা নিতান্ত জরুরী। জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার একমাত্র উপায় হলো পৃথিবী ব্যাপী প্রাকৃতিক বনের সংখ্যা বাড়ানো। পাড়াবন সংরক্ষনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বন সৃজন করে বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ করার একটি অন্যতম উপায় হতে পারে।
What's Your Reaction?